ব্রহ্ম ও ব্রহ্মা কি ? এদের মধ্যে তফাত বা পার্থক্য কি ?

ব্রহ্মঃ  

হিন্দুধর্মে, ব্রহ্ম বা ব্রহ্মন্ হলো মহাবিশ্বে বিদ্যমান চূড়ান্ত ও অখণ্ড সত্যের ধারণা।হিন্দু দর্শনে এর অর্থ সৃষ্টির বস্তুগত, গুণগত, প্রামাণ্য ও অন্তিম কারণ।ব্রহ্ম সর্বব্যাপী, অনাদি ও অনন্ত, চিরসত্য ও পরমানন্দ যা নিজে অপরিবর্তনীয় হয়েও সকল পরিবর্তনের কারণ।ব্রহ্ম আধিভৌতিক ধারণা হিসেবে  বৈচিত্র্যের পিছনে একক আবদ্ধ ঐক্যকে বোঝায় যা মহাবিশ্বে বিদ্যমান।সনাতন ধর্ম বা হিন্দুধর্ম অনুসারে স্রস্টাকে ব্রহ্ম বলা হয়। এছাড়াও ঈশ্বর,ভগবান,পরমেশ্বর নামেও ডাকা হয়। জ্ঞানীর কাছে তিনি ব্রহ্ম। ব্রহ্ম শব্দের অর্থ সর্ববৃহৎ, ‘বৃহত্বাৎ ব্রহ্ম’। যাঁর থেকে বড় কেউ নেই, তিনি সকল সৃষ্টির মূল স্রস্টা এবং তাঁর মধ্যে সকল কিছুর অবস্থান ও বিলয়। ব্রহ্মকে পরমাত্মাও বলা হয়। বেদ ও উপনিষদে ব্রহ্মের মূল ধারনা পাওয়া যায়।

ব্রহ্ম হচ্ছে চিরন্তন সত্য,নিরাকার ও নির্গুন এবং নিশ্চল অবস্থায় অবস্থান করেন। তিনি অনাদি, অনন্ত, অজ এবং শাশ্বত। তাঁকে ‘ওঙ্কার’ বলা হয়। ওঙ্কার সংক্ষেপে ওঁ এবং এর পূর্ণরূপ অ-উ-ম। এর অর্থ হচ্ছে সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়কারী ব্রহ্ম। সমস্ত কিছুর মূল উৎস হল ব্রহ্ম এবং সব কিছুর আদি ও শেষ। পরম ব্রহ্মকে উপলব্ধি করা অর্থাৎ পরম সৌভাগ্য লাভ করা বা মোক্ষ্য লাভ করা।

ব্রহ্ম ও ব্রহ্মা কি ? এদের মধ্যে তফাত বা পার্থক্য কি ?
ব্রহ্ম ও ব্রহ্মা কি ? এদের মধ্যে তফাত বা পার্থক্য কি ?

শ্রীমদ্ভগবতগীতায় একটি শ্লোকে ব্রহ্ম তথা ঈশ্বর বা পরমাত্মা সম্পর্কে বলা হয়েছে –

অর্থাৎ ‘তুমি আদিদেব, তুমি অনাদি পুরুষ, তুমি বিশ্বের পরম আশ্রয় স্বরুপ, তুমি একমাত্র জ্ঞাতব্য এবং জ্ঞাতা। তুমি একমাত্র পরম স্থান। হে অনন্তরূপ, তুমি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রসারিত ‘ একমাত্র প্রভু।

  ত্বমাদিদেবঃ পুরুষঃ পুরাণ

  স্ত্বমস্য বিশ্বস্য পরং নিধানম্।

বেত্তাসি বেদ্যঞ্চ পরঞ্চ ধাম

ব্রহ্মাঃ

 ব্রহ্মা হলেন হিন্দুধর্মে সৃষ্টির দেবতা। পরব্রহ্মের ত্রিদেবতা বিষ্ণু ও শিবের সঙ্গে তিনি ত্রিমূর্তিতে বিরাজমান। তিনি সৃষ্টি, জ্ঞান ও বেদ এর সাথে সম্পর্কযুক্ত।তিনি অবশ্য হিন্দু বেদান্ত দর্শনের সর্বোচ্চ দিব্যসত্ত্বা ব্রহ্মের সমরূপ নন। বরং বৈদিক দেবতা প্রজাপতিকে ব্রহ্মার সমরূপ বলা চলে। [হিন্দু সৃষ্টিতত্ত্ব,সৃষ্টিতত্ত্ব কিংবদন্তিতে] ব্রহ্মা স্পষ্টত উল্লেখিত হয়েছেন, যদিও সৃষ্টিতত্ত্বের বিভিন্ন সংস্করণ রয়েছে। কিছু পুরাণে বলা হয়েছে, তিনি স্বর্ণডিম্ব বা হিরণ্যগর্ভ হতে স্বয়ং উদ্ভূত হয়েছেন। তবে, ব্রহ্মা বৈদিক দেবতা প্রজাপতির অনুরূপ।বৈষ্ণব সৃষ্টিতত্ত্ব অনুসারে, বিষ্ণুর নাভিকমল থেকে ব্রহ্মা উত্থিত হয়েছেন। এজন্য ব্রহ্মার নাম কমলযোনি বা পদ্মযোনি।

ত্বয়া ততং বিশ্বমনন্তরূপ। (১১/৩৮)

সনাতন ধর্মে ত্রিমূর্তিতে বিরাজমান ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর (শিব)। ব্রহ্মা হচ্ছে পরমেশ্বর বা ব্রহ্মের সৃষ্টি শক্তি। তিনি সৃষ্টির দেবতা, ব্রহ্মের সমরূপ নন। ব্রহ্মা হল বৈদিক দেবতা প্রজাপতির অনুরূপ। তিনি সাকার রূপে বিরাজমান। চতুর্মুখ ও চতুর্বাহু বিশিষ্ট, শ্মশ্রুমণ্ডিত, রক্তাভ বা স্বনার্ভ দেহধারী। তিনি পদ্মাসনে অবস্থান করেন এবং হংস বা সারস তাঁর বাহন। বিষ্ণু দেবতার নাভিকমল থেকে ব্রহ্মা উত্থিত হয়েছে জন্য ব্রহ্মার নাম কমলযোনি বা পদ্মযোনি। আরও নাম আছে স্বয়ম্ভু ও বিরিঞ্চ। দেবী সরস্বতী ব্রহ্মার সহধর্মিণী আর তাঁর সন্তানদেরকে বলা হয় মানসপুত্র। ব্রহ্মার অস্ত্র হল ব্রহ্মাস্ত্র, ব্রহ্মশিরাস্ত্র ও ব্রহ্মণ্ডাস্ত্র। তাঁর উৎসব পালন করা হয় কার্তিক পূর্ণিমা ও শ্রীবেরী ব্রহ্মোৎসবে।

ব্রহ্মার মন্ত্র –

  ওঁ বেদাত্মনায় বিদ্মহে হিরণ্যগর্ভায় ধীমহি তন্নো ব্রহ্মা প্রচেদয়াৎ।।

প্রনাম মন্ত্র হল –

 ” নমহস্ত বিশ্বেশ্বর বিশ্বধাম জগৎসবিত্রে সপ্তার্চিলোকায় চ ভূতলেশ সর্বান্তরস্থায় নমো নমস্তে।”

অর্থাৎ হে ভগবান বিশ্বেশ্বর, বিশ্বধাম, জগতের সৃষ্টিকারী, তোমাকে নমস্কার। হে পৃথিবীপতি, সপ্ত সূর্যরশ্মির আশ্রয়, সকলের অন্তরে অবস্থান কারী, তোমাকে পুনঃপুনঃ নমস্কার।

আর ও দেখুন:

হিন্দু ধর্মীয় প্রয়োজনীয় মন্ত্র সমূহ।

মহা শিবরাত্রি কি ? মহা শিবরাত্রি উৎসব পালনের গুরুত্ব ও শিবরাত্রির ব্রতকথার তাৎপর্যতা কি?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top